লন্ডন থেকে ফ্রান্স (বিশেষ করে প্যারিস) ভ্রমণ ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় রুট। ফ্রান্সের রোমান্টিক শহর প্যারিস, লুভর মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, এবং ফরাসি খাবার পর্যটকদের আকর্ষণ করে। লন্ডন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার জন্য ট্রেন, ফ্লাইট, ফেরি, বাস, এবং গাড়ি—বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা ২০২৫ সালের জন্য লন্ডন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়, খরচ, সময়, ভিসার প্রয়োজনীয়তা, এবং গুরুত্বপূর্ণ টিপস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভ্রমণের উপায়
লন্ডন থেকে ফ্রান্স (প্রধানত প্যারিস) যাওয়ার প্রধান উপায়গুলো হলো:
১. ট্রেন (ইউরোস্টার)
ইউরোস্টার হলো লন্ডন থেকে প্যারিস যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দ্রুত উপায়। এটি ইংলিশ চ্যানেলের নিচে চ্যানেল টানেল দিয়ে যায়।
-
রুট: লন্ডন সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল থেকে প্যারিস গারে দু নর্দ (Gare du Nord)
-
সময়: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
-
টিকিটের মূল্য:
-
স্ট্যান্ডার্ড ক্লাস: £৫২-£১৫০ (প্রায় ৮,০০০-২৩,০০০ টাকা)
-
স্ট্যান্ডার্ড প্রিমিয়ার/বিজনেস প্রিমিয়ার: £১২০-£৩১০ (প্রায় ১৮,০০০-৪৭,০০০ টাকা)
-
-
কতবার চলে: প্রতিদিন ১৫-২০টি ট্রেন
-
সুবিধা:
-
শহরের কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে সরাসরি যাত্রা
-
আরামদায়ক আসন, ফ্রি Wi-Fi, খাবারের ব্যবস্থা
-
বিমানবন্দরের তুলনায় কম ঝামেলা (কম চেক-ইন সময়)
-
-
বুকিং:
-
অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: https://www.eurostar.com/
-
অন্যান্য: Trainline, Omio
-
-
টিপস:
-
৩-৬ মাস আগে বুকিং করলে সস্তা টিকিট পাওয়া যায়।
-
সকাল বা সন্ধ্যার ট্রেন সাধারণত সস্তা।
-
Snap টিকিট (ডিসকাউন্টেড) চেক করুন।
-
২. ফ্লাইট
লন্ডন থেকে প্যারিস ফ্লাইট দ্রুত কিন্তু বিমানবন্দরে চেক-ইন ও সিকিউরিটি সময়ের কারণে ইউরোস্টারের তুলনায় সামগ্রিক সময় বেশি লাগতে পারে।
-
প্রধান বিমানবন্দর:
-
লন্ডন: Heathrow (LHR), Gatwick (LGW), Luton (LTN), Stansted (STN), London City (LCY)
-
প্যারিস: Charles de Gaulle (CDG), Orly (ORY), Beauvais (BVA)
-
-
এয়ারলাইনস: British Airways, Air France, easyJet, Vueling, Ryanair
-
ফ্লাইটের সময়: ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
-
মোট সময়: চেক-ইন, সিকিউরিটি, এবং বিমানবন্দর থেকে শহরে যাতায়াত মিলিয়ে ৩.৫-৪.৫ ঘণ্টা
-
টিকিটের মূল্য:
-
বাজেট এয়ারলাইন (easyJet, Ryanair): £২০-£৮০ (প্রায় ৩,০০০-১২,০০০ টাকা)
-
ফুল-সার্ভিস (British Airways, Air France): £৮০-£২৫০ (প্রায় ১২,০০০-৩৮,০০০ টাকা)
-
-
বুকিং: Skyscanner, Kayak, Google Flights, বা সরাসরি এয়ারলাইন ওয়েবসাইট
-
টিপস:
-
বাজেট এয়ারলাইনের ক্ষেত্রে লাগেজ ফি চেক করুন।
-
Beauvais বিমানবন্দর প্যারিস থেকে ৮৫ কিমি দূরে, তাই সময় ও বাস খরচ হিসাব করুন।
-
সপ্তাহের মাঝামাঝি (মঙ্গল/বুধ) ফ্লাইট সস্তা হয়।
-
৩. ফেরি
ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফেরিতে ফ্রান্স যাওয়া একটি দৃশ্যমান এবং আরামদায়ক বিকল্প।
-
রুট:
-
ডোভার (ইংল্যান্ড) থেকে ক্যালাইস বা ডানকার্ক (ফ্রান্স)
-
-
কোম্পানি: P&O Ferries, DFDS Seaways, Irish Ferries
-
সময়: ১.৫-২ ঘণ্টা (ফেরি যাত্রা) + লন্ডন থেকে ডোভার (ট্রেন/বাসে ১.৫-২ ঘণ্টা)
-
মোট সময়: ৪-৫ ঘণ্টা (ক্যালাইস থেকে প্যারিস ট্রেনে ১.৫-২ ঘণ্টা অতিরিক্ত)
-
মূল্য:
-
ফুট প্যাসেঞ্জার: £৩০-£৮০ (প্রায় ৪,৫০০-১২,০০০ টাকা)
-
গাড়ি সহ: £৮০-£২০০ (প্রায় ১২,০০০-৩০,০০০ টাকা)
-
-
সুবিধা: সমুদ্রের দৃশ্য, গাড়ি বা পোষা প্রাণী নিয়ে যাওয়ার সুবিধা
-
বুকিং: https://www.poferries.com/ বা https://www.dfds.com/
-
টিপস:
-
ডোভার থেকে ক্যালাইস রুট সবচেয়ে জনপ্রিয়।
-
আগাম বুকিং করলে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
-
ফেরি টার্মিনালে ফ্রি Wi-Fi এবং খাবারের দোকান রয়েছে।
-
৪. বাস
বাজেট ভ্রমণকারীদের জন্য বাস একটি সাশ্রয়ী বিকল্প, তবে সময় বেশি লাগে।
-
কোম্পানি: FlixBus, BlaBlaCar Bus
-
রুট: লন্ডন (Victoria Coach Station) থেকে প্যারিস (Bercy Seine)
-
সময়: ৭-৯ ঘণ্টা (চ্যানেল টানেল বা ফেরি দিয়ে)
-
মূল্য: £২০-£৫০ (প্রায় ৩,০০০-৭,৫০০ টাকা)
-
সুবিধা: ফ্রি Wi-Fi, পাওয়ার সকেট, আরামদায়ক আসন
-
বুকিং: https://www.flixbus.co.uk/ বা https://www.blablacar.co.uk/
-
টিপস:
-
রাতের বাস নিলে থাকার খরচ বাঁচে।
-
টিকিট আগে কিনলে সস্তা পাওয়া যায়।
-
পাসপোর্ট এবং ভিসা সঙ্গে রাখুন (বর্ডার চেক)।
-
৫. গাড়ি
নিজের গাড়ি বা ভাড়ার গাড়িতে ফ্রান্স যাওয়া নমনীয় এবং দৃশ্যমান।
-
রুট: লন্ডন থেকে ফোকস্টোন (ইউরোটানেল) বা ডোভার (ফেরি) → ক্যালাইস → প্যারিস
-
ইউরোটানেল (Le Shuttle):
-
সময়: ৩৫ মিনিট (ফোকস্টোন থেকে ক্যালাইস)
-
মূল্য: £৮০-£২৫০ (প্রায় ১২,০০০-৩৮,০০০ টাকা) গাড়ি প্রতি
-
বুকিং: https://www.eurotunnel.com/
-
-
ফেরি: ডোভার-ক্যালাইস, ১.৫-২ ঘণ্টা, £৮০-£২০০
-
মোট সময়: লন্ডন থেকে প্যারিস ৫-৬ ঘণ্টা (৩৫০ কিমি)
-
খরচ:
-
জ্বালানি: £৫০-£৮০ (প্রায় ৭,৫০০-১২,০০০ টাকা)
-
টোল ফি (ফ্রান্স): €২০-€৩০ (প্রায় ২,৪০০-৩,৬০০ টাকা)
-
-
টিপস:
-
ফ্রান্সে ডানদিকে ড্রাইভ করতে হয়, তাই সাবধানে চালান।
-
গাড়ির বীমা এবং ইউরোপীয় ব্রেকডাউন কভারেজ নিন।
-
Crit’Air স্টিকার (প্যারিসে প্রয়োজন): https://www.certificat-air.gouv.fr/
-
ভিসার প্রয়োজনীয়তা
-
বাংলাদেশি নাগরিক: ফ্রান্স শেনজেন এলাকার সদস্য, তাই শেনজেন ভিসা প্রয়োজন।
-
ফি: €৮০ (প্রায় ১২,০০০ টাকা) + VFS সার্ভিস ফি €১৫
-
আবেদন: VFS Global-এর মাধ্যমে: https://visa.vfsglobal.com/bgd/en/fra/
-
কাগজপত্র:
-
পাসপোর্ট (৬ মাস মেয়াদী)
-
২টি ছবি (৩৫ মিমি x ৪৫ মিমি)
-
ব্যাংক স্টেটমেন্ট (৬ মাসের, প্রতিদিন €৭০ খরচের প্রমাণ)
-
ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স (€৩০,০০০ কভারেজ)
-
ফ্লাইট/ট্রেন ইটিনারারি, হোটেল বুকিং
-
পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
-
-
প্রসেসিং সময়: ১৫-৩০ দিন
-
-
দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক: শেনজেন ভিসা প্রয়োজন। প্রক্রিয়া একই।
-
ইউকে নাগরিক: ব্রেক্সিটের পর শেনজেন এলাকায় ১৮০ দিনে ৯০ দিন ভিসা-মুক্ত থাকা যায়। ETIAS (২০২৫ থেকে): €৭ (প্রায় ১,০০০ টাকা), https://www.etias.eu/
খরচের হিসাব
-
ইউরোস্টার: £৫২-£৩১০ (প্রায় ৮,০০০-৪৭,০০০ টাকা)
-
ফ্লাইট: £২০-£২৫০ (প্রায় ৩,০০০-৩৮,০০০ টাকা)
-
ফেরি: £৩০-£২০০ (প্রায় ৪,৫০০-৩০,০০০ টাকা)
-
বাস: £২০-£৫০ (প্রায় ৩,০০০-৭,৫০০ টাকা)
-
গাড়ি: £১৫০-£৩৬০ (প্রায় ২২,৫০০-৫৪,০০০ টাকা, জ্বালানি ও টোল সহ)
-
থাকার খরচ (প্যারিস): প্রতিদিন €৫০-€২০০ (প্রায় ৭,৫০০-৩০,০০০ টাকা)
-
ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স: €৩০-€১০০ (প্রায় ৪,৫০০-১৫,০০০ টাকা) ১৫ দিনের জন্য
-
ভিসা ফি (প্রযোজ্য হলে): €৮০-€৯৫ (প্রায় ১২,০০০-১৪,২৫০ টাকা)
সেরা বিকল্প নির্বাচন
-
দ্রুত ভ্রমণের জন্য: ইউরোস্টার (২.৫ ঘণ্টা, শহর কেন্দ্রে)
-
বাজেট ভ্রমণের জন্য: বাস (FlixBus, £২০ থেকে)
-
দৃশ্যমান ভ্রমণের জন্য: ফেরি (ডোভার-ক্যালাইস)
-
নমনীয়তার জন্য: গাড়ি (ইউরোটানেল বা ফেরি)
-
মাঝারি বাজেটের জন্য: ফ্লাইট (easyJet, Ryanair)
গুরুত্বপূর্ণ টিপস
-
আগাম বুকিং: ইউরোস্টার, ফ্লাইট, বা ফেরির টিকিট ২-৩ মাস আগে কিনলে সস্তা হয়।
-
ভিসা চেক: বাংলাদেশি বা দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক হলে শেনজেন ভিসা নিশ্চিত করুন।
-
প্যাকিং: ফ্রান্সে আবহাওয়া পরিবর্তনশীল। গ্রীষ্মে হালকা পোশাক, শীতে জ্যাকেট নিন।
-
পরিবহন পাস: প্যারিসে মেট্রোর জন্য Navigo বা Paris Visite পাস কিনুন।
-
নিরাপত্তা: প্যারিসে পকেটমারি থেকে সাবধান থাকুন, বিশেষ করে মেট্রো ও পর্যটন স্থানে।
-
ভাষা: ফরাসি ভাষা না জানলেও ইংরেজিতে কাজ চলে। “Bonjour” বা “Merci” বললে স্থানীয়রা খুশি হয়।
-
প্রতারণা এড়ান: শুধুমাত্র অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (Eurostar, FlixBus, VFS Global) ব্যবহার করুন।
-
ট্রাভেল এজেন্সি: Trainline, Omio, বা Skyscanner-এর মতো বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন।
প্যারিসে করণীয়
-
আইফেল টাওয়ার: সন্ধ্যায় আলোকিত দৃশ্য দেখুন।
-
লুভর মিউজিয়াম: মোনালিসা ও শিল্পকর্ম দেখুন।
-
নটর-ডাম ক্যাথিড্রাল: ঐতিহাসিক স্থাপত্য।
-
স্যাক্রে-কোয়ের: মন্টমার্ত্রে অবস্থিত, দৃশ্যমান পাহাড়।
-
সেন নদী ক্রুজ: রোমান্টিক নৌকা ভ্রমণ।
-
ফরাসি খাবার: ক্রোয়াসঁ, ম্যাকারন, এবং ফ্রেঞ্চ ওয়াইন চেখে দেখুন।